রাহুলের ভাঙা বাড়িতে প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ এ যেন আনন্দের হাটবাজার
বার্তালোক ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:৪৮ মিনিটশিল্প-সংস্কৃতির কদর করতে জানে ফরাসিরা। বাংলাদেশ সফরে এসে কথাটা যেন আরেকবার মনে করিয়ে গেলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। মাত্র ১৯ ঘণ্টার ঝটিকা সফরে এসেও নানা ব্যস্ততার ফাঁকে তিনি হাজির হয়েছেন বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী রাহুল আনন্দের বাড়িতে। গান, আনন্দ আড্ডায় ব্যয় করেছেন এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের এই সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মকাণ্ডের আদ্যোপান্ত নিয়ে বিশেষ এই আয়োজন
‘ভাঙা বাড়ি’তে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট
ধানমণ্ডির একটি ভাড়া বাড়িতে গানের দল ‘জলের গান’-এর সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুল আনন্দ ও চিত্রশিল্পী ঊর্মিলা শুক্লা দম্পতি থাকেন, সঙ্গে ছেলে তোতা। পুরনো বাড়িটির কোনো নাম নেই, এটিকে ভালোবেসে রাহুল আনন্দ নাম দিয়েছেন ‘ভাঙা বাড়ি’। সেই বাড়িতেই পা পড়ল ফ্রান্সের ২৫তম প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর। রবিবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাত পৌনে ১২টায় রাহুল আনন্দের সেই বাড়িতে হাজির হন ইমানুয়েল ম্যাখোঁ।
মাত্র তিন দিন আগে প্রেসিডেন্টের আগমনের খবর জেনেছিলেন রাহুল।
অতিথিবরণ
অতিথি বরণ করতে বাড়তি কৃত্রিমতা রাখেননি রাহুল আনন্দ। সদর দরজার চৌকাঠ পেরোলেই পিচঢালা আঙিনা, সন্ধ্যায় আঙিনায় রংবেরঙের ফুলের পাপড়ি বিছিয়ে আলপনা এঁকেছেন রাহুলের স্ত্রী ঊর্মিলা শুক্লা। এতে ছিল গোলাপ ও গাঁদা।
ফুলেল সাজসজ্জা দেখে বিমোহিত হয়েছেন ম্যাখোঁ। এ সময় বাঁশি বাজিয়ে তাঁকে বরণ করে নেন রাহুল।
ম্যাখোঁ তখন বাংলা লোকসংগীতের মুগ্ধ শ্রোতা
রাহুলের বাড়ি যেন জাদুঘর
‘ভাঙা বাড়ি’তে ঢুকে প্রেসিডেন্ট সোজা চলে যান রাহুলের স্টুডিওতে। স্টুডিওর দেয়ালজুড়ে থরে থরে সাজানো বাদ্যযন্ত্র।
দ্রৌপদী, পাগলা, পদ্মা, মনদোলা, তোতাবান, চন্দ্রবান—রাহুলের নিজ হাতে তৈরি বাদ্যযন্ত্রগুলোর বাহারি সব নাম। এটিকে স্টুডিও বললে ভুল হবে, যেন রীতিমতো বাদ্যযন্ত্রের জাদুঘর। সব বাদ্যযন্ত্রের নাম ও কাজ জানতে চান ম্যাখোঁ। বাদ্যযন্ত্রের প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বিশেষ আগ্রহের খবর জানে পুরো বিশ্ব। জুলাইয়ে ফ্রান্স সফরে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে করে ম্যাখোঁর জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন চন্দন কাঠের তৈরি সেতারের রেপ্লিকা।
আমি বাংলায় গান গাই
গানে-আড্ডায় বাংলাদেশের লোকসংগীতের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারের সঙ্গে ম্যাখোঁকে পরিচয় করিয়ে দিলেন রাহুল। শুনিয়েছেন লালন থেকে প্রতুল মুখোপাধ্যায়, আব্বাসউদ্দীন আহমদ থেকে আব্দুল আলীমের গান। ‘আমি বাংলায় গান গাই’, ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, কোন দূরে যাও চইলা’ গেয়ে শোনান রাহুল। সঙ্গীদের নিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনলেন ম্যাখোঁ।
সময় শেষ, তবু…
সূচি অনুযায়ী রাহুল আনন্দের স্টুডিওতে ৪০ মিনিটের মতো থাকার কথা ম্যাখোঁর। গানে কথায় এতটাই মুগ্ধ হলেন প্রেসিডেন্ট, উঠলেন পুরো এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর।
রং চায়ে চুমুক
গান-আড্ডায় অল্প সময়ের মধ্যেই রাহুলের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সখ্য গড়ে ওঠে। রাহুলের ঘরে তিনি আরাম করে রং চায়ে চুমুক দিয়েছেন। রাহুল জানিয়েছেন, এর বাইরে প্রেসিডেন্ট আর কিছুই খাননি।
রাহুলের দেওয়া উপহার একতারা হাতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট
ম্যাখোঁকে দিলেন একতারা
হাতে যে একতারা বাজিয়ে গান গেয়েছেন রাহুল, সেটি উপহার দেন প্রেসিডেন্টকে। হাতে পেয়ে ম্যাখোঁ সেটি বাজানোর চেষ্টা করেন। মরমি শিল্পী আব্দুল আলীমের ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা’ গাইতে গাইতে রাহুল তাঁকে দেখিয়ে দেন কিভাবে বাজাতে হবে। তারপর দুজন একসঙ্গে বাজাতে থাকেন। রাহুল বলেন, ‘আশা করি, এই উপহার আপনাকে বাংলাদেশের কথা মনে করিয়ে দেবে। এটি প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি করা। আমি এভাবেই বাদ্যযন্ত্র তৈরি করি।’
এই সেই কলম, যে কলমে লেখা রাহুলের গান-কবিতা ফের শুনবেন ম্যাখোঁ
ম্যাখোঁ দিলেন কলম
আড্ডার এক পর্যায়ে রাহুলকে প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার স্বপ্ন কী?’ রাহুল বলেন, ‘সবুজ পৃথিবী দেখতে চাই।’ এরপর প্রেসিডেন্ট জানতে চান, ‘সে ক্ষেত্রে তোমার ভূমিকা কী?’ রাহুল বলেন, ‘আমি যেখানেই গাইতে যাই, সেখানেই গাছ লাগানো ও নদী-প্রকৃতির যত্ন নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। ১৯৯৪ সাল থেকে ফাঁকা জায়গায় আমি গাছ লাগাই, কিছুদিন আগে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তেও গাছ লাগিয়েছি।’ বিদায়ের আগে ম্যাখোঁ একটি কলম উপহার দিয়েছেন রাহুলকে। রাহুল প্রতিশ্রুতি দেন, কলমটি দিয়ে তিনি নতুন গান লিখবেন। ‘তিনি বলেছেন, আমি যেন এই কলম দিয়ে গান-কবিতায় প্রকৃতির কথা লিখি। সেই গান, কবিতা তিনি শুনবেন। আমি ছোট মানুষ, আমার সাধ্যের মধ্যে তাঁকে সুখী করার চেষ্টা করেছি’, বললেন রাহুল। যাওয়ার আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে অটোগ্রাফ চেয়ে নিয়েছে রাহুল আনন্দ ও ঊর্মিলা শুক্লা দম্পতির ছেলে তোতা।
সঙ্গে আরো যাঁরা ছিলেন
ম্যাখোঁর সঙ্গে রাহুলের স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সংগীতশিল্পী আশফিকা রহমান, কামরুজ্জামান স্বাধীন, আফরোজা সারাসহ আরো কয়েকজন।
সংগীতানুরাগী ম্যাখোঁ
ইমানুয়েল ম্যাখোঁ প্রশাসন বরাবরই সংস্কৃতিকে আলাদা গুরুত্ব দেয়। যেকোনো দেশ সফরে গেলে সেই দেশের শিল্পীদের সঙ্গে সময় কাটান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। ঢাকায় ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের তত্ত্বাবধানে রাহুল আনন্দের স্টুডিও পরিদর্শন করলেন ম্যাখোঁ। ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট একজন সংগীতানুরাগী। নিজেও শখের বশে গান করেন। এ বছর এপ্রিলে প্যারিসের রাস্তায় গাইতে দেখা গেছে তাঁকে, পরে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি একজন পিয়ানিস্টও। পিয়ানোতে ডিপ্লোমা করেছেন। বেশ ভালো গিটারও বাজাতে পারেন। যৌবনের শুরুতে তিনি থিয়েটারও করতেন। ১৫ বছর বয়সে থিয়েটারবিষয়ক এক কর্মশালায় গিয়েই তিনি প্রেমে পড়েছিলেন ফার্স্ট লেডি ব্রিজিত মেরি-ক্লদ ম্যাখোঁর। শিক্ষিকা ব্রিজিতের বয়স তখন ৩৯ বছর।
সূত্র: কালের কণ্ঠ